
.
শিকড়ের পাতা থেকে-
“বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়”
-মোঃ ফরহাদ হোসেন
বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলার জ্ঞান চর্চার প্রান কেন্দ্র “বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়” ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে বজ্রযোগিনীর গুহপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয়। মহান দানবীর, অকৃতিম বিদ্যুৎসাহী ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী গুহপাড়ার তৎকালীন জমিদার বাবু জয় কিশোর গুহ ও বাবু কালী কিশোর গুহ ভ্রাতৃদ্বয় বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা। “বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়” এর ইতিহাস সুদূর প্রাচীন। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন অসংখ্য বুদ্ধিজীবি ও আন্তর্জাতিক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব। সূচনায় যিনি গোড়া পত্তন করেছিলেন তিনি হচ্ছেন আলোকিত মানুষ গধাই মাষ্টার। তিনি দীর্ঘদিন (এক যুগের বেশী) গধাই মাষ্টারের পাঠশালা নামে স্কুলটি পরিচালনা করেন। তার অবর্তমানে প্রথমত এ স্কুলটি শংকর বন্দের উমাকান্ত ঘোষের বাড়ীতে গভর্নমেন্ট সার্কেল স্কুল রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর দু-চার বছর পর স্কুলটি আটপাড়ার বসুদের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। এর এক বছর পর স্কুলটি গুহপাড়ার জমিদার বাবু বসন্ত কুমার গুহের /বাবু জয় কিশোর গুহের বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। বজ্রযোগিনী জে,কে, বহুমুখী উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় নামে বিদ্যালয়টি আত্ম প্রকাশ ঘটলেও ১০.০৭.১৯৪১ ইং তারিখ বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ ইংরেজী বিদ্যালয় নামে ১৮ ই নভেম্বর ১৯৪০ ইং তারিখ থেকে ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি কর্তৃক ১ম স্বীকৃতি লাভ করে। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড, ঢাকা কর্তৃক স্বীকৃতি প্রাপ্ত বর্তমানে বিদ্যালয়টির নাম “বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়” । মহান দানবীর, অকৃতিম বিদ্যুৎসাহী ও বিশিষ্ট শিক্ষানুরাগী গুহপাড়ার তৎকালীন জমিদার বাবু জয় কিশোর গুহ ও বাবু কালী কিশোর গুহ ভ্রাতৃদ্বয়ের প্রচেষ্টায় ১৮৮৩ খ্রীষ্টাব্দে স্কুলটি ইংরেজী বিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। তাঁদের আর্থিক সাহায্য ও সহযোগিতায় গধাই মাষ্টারের পাঠশালা স্থলে (বর্তমান স্থলে) একতলা আয়তাকার ভবনে স্কুলটি পূর্ণতা লাভ করে।
শুরুতেই অনেক শিক্ষর্থী ছিল। শ্রেনী পরিধি ছিল ১ম শ্রেনী থেকে ১০ম শ্রেনী পর্যন্ত। বাবু অম্বিকা চরণ ঘোষ প্রথম প্রধান শিক্ষকের সম্মান লাভ করেন এবং শ্রীযুক্ত বাবু গিরিশ চন্দ্র গুহ সেক্রেটারী পদে আসিন হন। প্রায় ১০ জন শিক্ষক নিয়ে আরম্ভ হওয়া বিদ্যালয় ধারাবাহিকভাবে সাফল্যের সাথে অতিবাহিত হতে থাকে। কিন্তু সময় ও কালের গর্ভে বিলীন হতে থাকে বিদ্যালয়ের শত বছরের অর্জিত সাফল্য ও ঐতিহ্য। বিদায় হল বাংলার পূর্ণ ভূমি থেকে বৃটিশ আর পাক শাসক গোষ্ঠী। মহান ভাষা আন্দোলনের অভিজ্ঞতায়, মুক্তিবাহিনীর অদম্য সাহসিকতায় বাঙ্গালী তথা বাংলাদেশ পেল স্বাধীনতা। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বিদ্যালয়ের সার্বিক বিষয়েই কেন জানি ঘাটতি, স্থবিরতা দেখা দেয়। ফলে আস্তে আস্তে স্কুলের মান অবনতি হতে থাকে।
১৯৭৬ সাল হতে বিদ্যালয়ের প্রশাসনিক, আর্থিক, অবকাঠামো ও শিক্ষার্থী সংখ্যার অবনতি দেখা দেয়। ১৯৭৮ সালে আর্থিক অবস্থার চরম বিপর্যয় ঘটে। এ আঁধার ক্ষণে ২রা ফেব্রুয়ারী ১৯৭৮ সালে ৪র্থ শ্রেনীতে আমি ভর্তি হই। এ কঠিনতম সময়ে বিদ্যালয়ের সফল প্রধান শিক্ষক আমার স্যার বাবু হর্ষনাথ দে অবসর গ্রহণ করেন। কালোছায়া যেন স্কুলটিকে আরও চেপে ধরে। ১৯৭৯ সালের অডিট রির্পোটে দেখা যায় যে, প্রতি মাসে স্কুল তহবিলে ঘাটতি ১৫৪০/- টাকা। শিক্ষক-কর্মচারীদের ৫/৬ মাসের বেতন বাকী। এমতাবস্থায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকগণ যখন হাতাশাগ্রস্থ, তখন এগিয়ে আসেন বিদ্যালয়ের হিতাকাঙ্খী প্রাক্তন ছাত্র আব্দুস সাত্তার হাওলাদার, আব্দুল কুদ্দুছ চৌধুরী ছানা মিয়া, মোঃ তমিজ উদ্দিন হালদার, জহিরুল হক সেন্টু মিয়া, আব্দুল বাসেত লস্কর, আঃ মান্নান তালুকদার, মোঃ মজিবুর রহমান শিকদার, খান আব্দুস সোবহান, আমির আলী হাওলাদার, ডাঃ শামসুল হক গাজী, এস.এম.বদিউজ্জামানসহ আরও অনেকে এবং প্রাক্তন ছাত্র সমিতি গঠন করে তারা মাসিক ১৫৪০/- টাকা প্রদানের সিদ্ধান্তসহ বেশকিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাদের আবেদনে সারা দিয়ে জনাব নুর হোসেন লস্কর, জনাব আবুল হাশেম লস্কর ও জনাব আব্দুল বাসেত লস্কর ভ্রাতৃত্রয় প্রায় ১,৫০,০০০/- টাকা ব্যয়ে তাঁদের মায়ের নামে নুরুন নেছা ভবন নির্মাণ করে দেন।
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঠিক ১০০ বছর পর ১৯৮৩ ইং সনে প্রাক্তন ছাত্র সমিতি ও তৎকালীন বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির আমন্ত্রণে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবঃ) এ,কে,এম,শামসুল ইসলাম বিজ্ঞান ভবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করতে বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শন দিবসে তাঁকে ভাঙ্গা মোড় হতে বিদ্যালয় পর্যন্ত ছাত্র/ছাত্রীরা ফুলের শুভেচ্ছা জানায়। সেইদিন তিনি আমাদের আধুনিক নতুন ভবন নির্মাণের স্বপ্ন দেখিয়ে ছিলেন। তাঁর একক প্রচেষ্টায় ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় প্রায় দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে স্কুলটি বাংলাদেশের অন্যতম আধুনিক বিদ্যালয়ে পরিনত হয়। বাংলাদেশ সরকার ও ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের মধ্যে বন্যা বিধ্বস্ত ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনঃ নির্মাণের জন্য ১.৫ মিলিয়ন ডলারের অনুদান চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চার বিভাগে ৪টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ঢাকা বিভাগের ঐতিহাসিক বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জ জেলার দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিদ্যাপিঠ বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়টি বিবেচনা করেন।
এ দিকে আয়তাকার একতলা ভবন ও কাঠ টিনের বিদ্যালয় ভবনটি ৩৫০০০০/- টাকায় চুড়াইন নিবাসী মোঃ নাজিম উদ্দিন হাওলাদারের নিকট খোলা ডাকে বিক্রয় করা হয় এবং ০৭.০৮.১৯৮৯ ইং তারিখ জনাব আবুল হোসেন ,ঢাকা এর ঠিকাদারিত্বে বর্তমান আধুনিক ভবনের নির্মাণ কাজ শুর করেন। ১৯৯২ ইং সনে আধুনিক সুযোগ সুবিধায় ৩(তিন) তলা ভবনে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়ে অদ্যাবধি ধারাবাহিক ছন্দে অতিক্রম করল ২০১৬ খ্রীষ্টাব্দ অর্থাৎ ১৩৪ বছর। ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় প্রাপ্ত সুবিধাসমূহ-০১.তিনতলা একাডেমিক ভবন কাম প্রশাসনিক ভবন, ০২. একটি মসজিদ ভবন, ০৩. একটি গভীর নলকুপ, ০৪. ভিতর-বাহিরে বিদ্রুৎ লাইন, ০৫. আভ্যন্তরীন রাস্তা, ০৬. আসবাবপত্র, ০৭. পাঠাগার ও ০৮. ২টি ল্যাব। মূল ভবনের ৪র্থ তলা ও ২য় একাডেমিক ভবন (প্রাইমারী ভবন)সহ অন্যান্য উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে মাননীয় মন্ত্রী (সাবেক) এম,শামসুল ইসলাম সাহেবের অবদান স্কুল ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছে।
প্রতিষ্ঠা লগ্নের আয়তাকার মূল ভবনটি খুবই আকর্ষনীয় ছিল। প্রধান ফটক ছিল পুকুরের মধ্যখানের পশ্চিম দিকের ঘাটলা সোজা। ফটক দিয়ে ঢুকলেই বামে ছিল প্রধান শিক্ষক মহোদ্বয়ের কক্ষ আর ডানে ছিল ১০ম শ্রেনীর শ্রেনী কক্ষ। পূর্ব দক্ষিন কোনের রুমে চলত ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম। দক্ষিন দিকে বাহির দিয়ে সে রুমে ঢুকার জন্য একটি দরজাও ছিল। দক্ষিন পশ্চিমের দরজা দিয়ে ১৫ গজ দূরে ছিল ৪টি ঝুলন্ত শৌচাগার। শৌচাগারের সাথে পূর্ব দিকে মিলানো ৩টি খোলা মূত্রাগার ছিল। যা ছাত্ররা ব্যবহার করত। পশ্চিম উত্তর কোনের রুমে ৩য় শ্রেনীর ক্লাশ হত। এ রুমের উত্তর পাশে একটি দরজা ছিল। পর্ব বা অনুষ্ঠান উৎসবে রুমটি গ্রীন রুম হিসাবে ব্যবহার হত। উত্তর দিকের সকল রুমের পাটিশন খুলে তৈরী হত বিশালাকার হলরুম। উত্তর পূর্ব পাশের ২য় গেট দিয়ে প্রবেশ করতে হত নিচের ক্লাশের শিক্ষার্থীদের। দ্বিতীয় গেটের বাহিরে পুকুর কোনে ছিল বুড়ির ঘর। সেখানে ইসলামিয়াত ক্লাশ হত। বর্তমান প্রধান বা প্রথম গেটের নিচে ছিল খাল। খালের উপর ছিল পুল। আয়তাকার ভবনের ভিতরে চতুর্দিকে ছিল চওড়া বারান্দা। মধ্যখানে বিরাট খোলা মাঠ। মাঠেই হত সমাবেশ। খেলাধুলার অনেকটাই এখানে চলত। ভিতরের মাঠের উত্তর পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল শহীদ মিনার। শহীদ মিনার ঘেঁসে পশ্চিমে ছিল পানীয় জলের আধার একমাত্র নলকুপ। একুশে ফেব্রুয়ারী অর্থাৎ জাতীয় দিবস গুলোতে হত কবিতা আবৃতি, প্রবন্ধ পাঠ, গান হত অভিনয়। বিদ্যালয় অঙ্গন থাকত সারাক্ষণ উচ্ছাসে মুখরিত। কি প্রেম ছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মাঝে। কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীত আর ফিরে আসবে না। অতীত স্মৃতির অভিজ্ঞতায় এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে শিক্ষার দ্যুতি ছড়িয়ে দিচ্ছে বিক্রমপুরের দ্বিতীয় প্রাচীনতম বিদ্যাপিঠ “বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়”। শিক্ষা-সংস্কৃতি, ক্রীড়া-কৃষ্টি, জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ বিক্রমপুর তথা মুন্সীগঞ্জের আলোকবর্তিকা শ্রীজ্ঞান অতীশ দীপঙ্করের জন্ম ভিটা বজ্রযোগিনীর রয়েছে বিশ্বজোড়া পরিচিতি, রয়েছে খ্যাতি। এ মাটিতে জন্ম গ্রহণ করেছেন অসংখ্য শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবি, বিজ্ঞানী, গবেষক, বিতার্কিক, ক্রীড়াবিদ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও সমাজকর্মী যারা আপন মহিমায় বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়কে করেছেন আরও আলোকিত। আমাদের প্রত্যাশা, আপন আলোয় সমৃদ্ধি পথে এগিয়ে যাবে “বজ্রযোগিনী জে,কে, উচ্চ বিদ্যালয়”।
. .